সাকিব আল-আমিন
গ্রীষ্মের ঝিমধরা বিকেল। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। গাছের পাতাগুলো দোল খাচ্ছে হাওয়ায়। রৌদ্রছায়ার সাথে খেলা করে চলছে গ্রামের সেই পুরোনো মেঠোপথ। দূর থেকে ভেসে আসছে পিপাসার্ত কাকের ডাক, আর ঠিক সেই পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন হাদিম সাহেব।
হাদিম সাহেব বয়োবৃদ্ধ মানুষ, যার চোখেমুখে ফেলে আসা জীবনের অনেক গল্পের রঙ জমে আছে। তার দুই নাতি সাকির ও সাদির ছোট ছোট পায়ে হেঁটে চলেছে তাঁর পাশে।
পথে যেতে যেতে তিনি নাতিদের শোনাচ্ছিলেন রূপকথার গল্প। তিনি বলা শুরু করলেন—
“তোমরা কি জানো, লাল পরী থাকতো এক রূপকথার দেশে? তার পায়ে ছিল রূপোর নূপুর। যখন সে হাঁটতো, চারদিক ঝিকিমিকি করে জ্বলতো…”
সাকির ও সাদির বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে শোনে আর গল্পের ছায়া গায়ে মেখে হাঁটে। পৃথিবীটা তখনো তাদের কাছে নিরাপদ, সুন্দর, উজ্জ্বল এবং নির্দোষ।
গল্প শুনে হাঁটতে হাঁটতে তারা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। সামনে বিশাল এক পোড়াবাড়ি।
কাঠামো ভাঙাচোরা, দেয়ালের ইটপাথর আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঘন ঝোপঝাড়ে ঘেরা, যেন কেউ বহুদিন ছুঁয়েও দেখে না। আর আশ্চর্যজনকভাবে, পথও এখানে এসে শেষ হয়ে গেছে। পথ আর এগোয় না।
“চলো একটু দেখি” চাপা কণ্ঠে বললেন হাদিম সাহেব।
নাতিদের বুকের মধ্যে একটা অজানা ভয় বাজতে থাকে, তবু দাদার হাত শক্ত করে ধরে তারা এগিয়ে যায়।
পোড়াবাড়ির ভেতর ঢুকতেই কেমন একটা গা ছমছমে অনুভূতি হলো তাদের। সব ঘরের দরজায় বড় বড় তালা ঝুলছে। তবে কেবল একটিমাত্র দরজায় তালা দেওয়া নেই। সে দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতর থেকে আসছে ঠাণ্ডা বাতাসের ধাক্কা।
হাদিম সাহেব হাত বাড়ালেন। দরজা খুললেন ধীরে ধীরে।
তারপর যা তিনি দেখলেন, তা ছিল এক বিভীষিকার ছবি। ভেতরের দৃশ্য দেখে ঘামতে থাকলেন তিনি।
তিনি দেখলেন— একদল ডাকাত বন্দী নারীদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। নারীদের কান্নার শব্দ যেন এই পোড়াবাড়ির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
ভয়ংকর নীরবতা। এক মুহূর্তে হাদিম সাহেবের চোখে জল চলে এলো।
ঠিক তখনই দুজন ডাকাত এসে তাদের ধরে ফেললো। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো এক অন্ধকার ঘরে।
ডাকাত দলের এক সদস্য এগিয়ে এসে বললো— “আরে মূর্খ বুড়ো, এখানে কেনো এসেছো?”
হাদিম সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলেন, “ভুল করে এসেছি বাছা, দয়া করে আমাদের ছেড়ে দাও।”
ডাকাতেরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এবং বলে— “এখানে যারা আসে একবার, তারা ফেরে না কখনো আর।”
সেই রাতে হাদিম সাহেবের আর ঘুম আসেনি। চুপচাপ তিনি অন্ধকার ঘরের ভেতর বসে থাকলেন। এবং তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, “আমার যা হয় হোক, আমি আমার নাতিদের কিছুই হতে দেব না এবং এই নিরীহ মেয়েগুলোকেও না।”
তিনি লোভ দেখিয়ে ডাকাত দলের এক সদস্যকে নিজের কব্জায় আনেন।
তার থেকে জানতে পারেন ভয়াবহ সব তথ্য: এ পোড়াবাড়িটি হলো একটি পাচারচক্রের গোপন আস্তানা। বছরের পর বছর ধরে এখানে চলছে নারী নির্যাতন আর অন্ধকার জগতের জঘন্য ব্যবসা।
আর ভয়ানক সত্য হলো— এ বাড়ির অভিশাপ, যারা একবার এখানে আসে, তারা অথবা তাদের প্রিয়জন চিরকাল কোনো না কোনোভাবে হারিয়ে যায়। এসব ঘটনা শুনে হাদিম সাহেবর চোখে রক্তজল বইতে শুরু হতে লাগলো। পরের দিন রাতে।
ডাকাতেরা যখন ঘুমিয়ে পড়েছে গভীর ঘুমে।
ঘুমন্ত ডাকাতদের ফাঁকি দিয়ে একে একে বন্দীদের বাইরে পাঠাতে শুরু করেন হাদিম সাহেব।
শেষে দুই নাতিকেও নিরাপদে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন।
কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে ডাকাতেরা টের পেয়ে যায়। বাজে বিপদ ঘণ্টা। চারদিকে ভীষণ হট্টগোল এবং শুরু হয় গোলাগুলির আওয়াজ।
কালক্ষেপণ করার উদ্দেশ্যে লড়াই করতে করতে, এক সময় হাদিম সাহেব ছুটে গিয়ে প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেন।
তারপর নিজের হাতে পোড়াবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন। আগুন ছড়িয়ে পড়ে। চারদিক লাল হয়ে ওঠে। পুড়ে যায় পাপের সব চিহ্ন। আর সেই আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকেন এক বৃদ্ধ মানুষ; যিনি জানেন, তার সময় ফুরিয়ে আসছে। এ আগুনে তাঁর শরীর পুড়ে যাবে, কিন্তু এই আগুনই বহন করবে শেষ আলো।
পরের দিন সকাল।
তাদের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ আসে।
সাকির আর সাদিরের মুখ থেকে শোনে পোড়াবাড়ির আগুনের গল্প।
পুলিশ তদন্ত চালাতে গিয়ে পোড়াবাড়ির ভেতর একটি ধুলোপড়া অ্যালবাম খুঁজে পায়।
অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে গিয়ে চমকে ওঠে সবাই। ছবিতে এক তরুণ। চোখে আগুন, মুখে নিষ্ঠুরতা। নাম লেখা ‘হাদিম মিয়া।’
পুলিশ নিশ্চিত হয়, যুবক বয়সে হাদিম ছিলেন এই পোড়াবাড়ির অপরাধী চক্রের মূল হোতা।
কিন্তু তিনি বৃদ্ধ বয়সে হয়ে যেভাবে নিজের জীবন দিয়ে পাপমোচনের চেষ্টা করলেন, তা সেই জনপদের মানুষের কাছে এক অন্যরকম ইতিহাস হয়ে থাকে।
গ্রামের শেষ প্রান্তে, হাদিম সাহেবের কবর দেওয়া হয়। কবরের দেয়ালে খোদাই করে লেখা হয় এপিটাফ:
আর বাতাসে ভেসে আসে পোড়াবাড়ির ধ্বংসস্তূপের ফাঁক গলে এক দুঃখী কিন্তু মুক্ত আত্মার নীরব প্রার্থনা। আজও যখন পোড়াবাড়ির জায়গায় ফুল ফোটে, তখন সে ফুল হয়তো গুনগুনিয়ে গান গায় আর মৃদু হাওয়ায় দুলতে দুলতে বলে, “ভয় নয়, হিংস্রতা নয়; সত্য, সুন্দর আর সৎ সাহসই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।”
পথে যেতে যেতে তিনি নাতিদের শোনাচ্ছিলেন রূপকথার গল্প। তিনি বলা শুরু করলেন—
“তোমরা কি জানো, লাল পরী থাকতো এক রূপকথার দেশে? তার পায়ে ছিল রূপোর নূপুর। যখন সে হাঁটতো, চারদিক ঝিকিমিকি করে জ্বলতো…”
সাকির ও সাদির বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে শোনে আর গল্পের ছায়া গায়ে মেখে হাঁটে। পৃথিবীটা তখনো তাদের কাছে নিরাপদ, সুন্দর, উজ্জ্বল এবং নির্দোষ।
গল্প শুনে হাঁটতে হাঁটতে তারা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। সামনে বিশাল এক পোড়াবাড়ি।
কাঠামো ভাঙাচোরা, দেয়ালের ইটপাথর আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঘন ঝোপঝাড়ে ঘেরা, যেন কেউ বহুদিন ছুঁয়েও দেখে না। আর আশ্চর্যজনকভাবে, পথও এখানে এসে শেষ হয়ে গেছে। পথ আর এগোয় না।
“চলো একটু দেখি” চাপা কণ্ঠে বললেন হাদিম সাহেব।
নাতিদের বুকের মধ্যে একটা অজানা ভয় বাজতে থাকে, তবু দাদার হাত শক্ত করে ধরে তারা এগিয়ে যায়।
পোড়াবাড়ির ভেতর ঢুকতেই কেমন একটা গা ছমছমে অনুভূতি হলো তাদের। সব ঘরের দরজায় বড় বড় তালা ঝুলছে। তবে কেবল একটিমাত্র দরজায় তালা দেওয়া নেই। সে দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতর থেকে আসছে ঠাণ্ডা বাতাসের ধাক্কা।
হাদিম সাহেব হাত বাড়ালেন। দরজা খুললেন ধীরে ধীরে।
তারপর যা তিনি দেখলেন, তা ছিল এক বিভীষিকার ছবি। ভেতরের দৃশ্য দেখে ঘামতে থাকলেন তিনি।
তিনি দেখলেন— একদল ডাকাত বন্দী নারীদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে। নারীদের কান্নার শব্দ যেন এই পোড়াবাড়ির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
ভয়ংকর নীরবতা। এক মুহূর্তে হাদিম সাহেবের চোখে জল চলে এলো।
ঠিক তখনই দুজন ডাকাত এসে তাদের ধরে ফেললো। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো এক অন্ধকার ঘরে।
ডাকাত দলের এক সদস্য এগিয়ে এসে বললো— “আরে মূর্খ বুড়ো, এখানে কেনো এসেছো?”
হাদিম সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলেন, “ভুল করে এসেছি বাছা, দয়া করে আমাদের ছেড়ে দাও।”
ডাকাতেরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এবং বলে— “এখানে যারা আসে একবার, তারা ফেরে না কখনো আর।”
সেই রাতে হাদিম সাহেবের আর ঘুম আসেনি। চুপচাপ তিনি অন্ধকার ঘরের ভেতর বসে থাকলেন। এবং তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, “আমার যা হয় হোক, আমি আমার নাতিদের কিছুই হতে দেব না এবং এই নিরীহ মেয়েগুলোকেও না।”
তিনি লোভ দেখিয়ে ডাকাত দলের এক সদস্যকে নিজের কব্জায় আনেন।
তার থেকে জানতে পারেন ভয়াবহ সব তথ্য: এ পোড়াবাড়িটি হলো একটি পাচারচক্রের গোপন আস্তানা। বছরের পর বছর ধরে এখানে চলছে নারী নির্যাতন আর অন্ধকার জগতের জঘন্য ব্যবসা।
আর ভয়ানক সত্য হলো— এ বাড়ির অভিশাপ, যারা একবার এখানে আসে, তারা অথবা তাদের প্রিয়জন চিরকাল কোনো না কোনোভাবে হারিয়ে যায়। এসব ঘটনা শুনে হাদিম সাহেবর চোখে রক্তজল বইতে শুরু হতে লাগলো। পরের দিন রাতে।
ডাকাতেরা যখন ঘুমিয়ে পড়েছে গভীর ঘুমে।
ঘুমন্ত ডাকাতদের ফাঁকি দিয়ে একে একে বন্দীদের বাইরে পাঠাতে শুরু করেন হাদিম সাহেব।
শেষে দুই নাতিকেও নিরাপদে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন।
কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে ডাকাতেরা টের পেয়ে যায়। বাজে বিপদ ঘণ্টা। চারদিকে ভীষণ হট্টগোল এবং শুরু হয় গোলাগুলির আওয়াজ।
কালক্ষেপণ করার উদ্দেশ্যে লড়াই করতে করতে, এক সময় হাদিম সাহেব ছুটে গিয়ে প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেন।
তারপর নিজের হাতে পোড়াবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন। আগুন ছড়িয়ে পড়ে। চারদিক লাল হয়ে ওঠে। পুড়ে যায় পাপের সব চিহ্ন। আর সেই আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকেন এক বৃদ্ধ মানুষ; যিনি জানেন, তার সময় ফুরিয়ে আসছে। এ আগুনে তাঁর শরীর পুড়ে যাবে, কিন্তু এই আগুনই বহন করবে শেষ আলো।
পরের দিন সকাল।
তাদের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ আসে।
সাকির আর সাদিরের মুখ থেকে শোনে পোড়াবাড়ির আগুনের গল্প।
পুলিশ তদন্ত চালাতে গিয়ে পোড়াবাড়ির ভেতর একটি ধুলোপড়া অ্যালবাম খুঁজে পায়।
অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে গিয়ে চমকে ওঠে সবাই। ছবিতে এক তরুণ। চোখে আগুন, মুখে নিষ্ঠুরতা। নাম লেখা ‘হাদিম মিয়া।’
পুলিশ নিশ্চিত হয়, যুবক বয়সে হাদিম ছিলেন এই পোড়াবাড়ির অপরাধী চক্রের মূল হোতা।
কিন্তু তিনি বৃদ্ধ বয়সে হয়ে যেভাবে নিজের জীবন দিয়ে পাপমোচনের চেষ্টা করলেন, তা সেই জনপদের মানুষের কাছে এক অন্যরকম ইতিহাস হয়ে থাকে।
গ্রামের শেষ প্রান্তে, হাদিম সাহেবের কবর দেওয়া হয়। কবরের দেয়ালে খোদাই করে লেখা হয় এপিটাফ:
“আমি পাপী ছিলাম,
তবু আলোর জন্য প্রাণ দিয়েছি।
আমাকে ক্ষমা করো।”
সাকির ও সাদির প্রায়ই সেই কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে— “দাদু, তুমি সত্যিকারের নায়ক ছিলে।”
আর বাতাসে ভেসে আসে পোড়াবাড়ির ধ্বংসস্তূপের ফাঁক গলে এক দুঃখী কিন্তু মুক্ত আত্মার নীরব প্রার্থনা। আজও যখন পোড়াবাড়ির জায়গায় ফুল ফোটে, তখন সে ফুল হয়তো গুনগুনিয়ে গান গায় আর মৃদু হাওয়ায় দুলতে দুলতে বলে, “ভয় নয়, হিংস্রতা নয়; সত্য, সুন্দর আর সৎ সাহসই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।”
1 মন্তব্যসমূহ
সাহিত্যের ছোঁয়া পেলাম।
উত্তরমুছুনপ্রিয় সুহৃদ,
এখানে আপনার মতামত জানাতে পারেন।
এখানকার মন্তব্য প্রাথমিক অবস্থায় সার্ভারে অদৃশ্যভাবে জমা থাকবে। অ্যাডমিন প্যানেল থেকে অনুমোদন দেওয়ার পর তা দৃশ্যমান হবে।
ধন্যবাদান্তে,
তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ, ‘ৎ’ (খণ্ড-ত)