মোহাম্মদ জসিমের কাব্যনাটক ‘দৃষ্টিসদন’

 

মোহাম্মদ জসিম

এখানে অন্ধদের ফুল দেখানো হয়। শেখানো হয় ফলের আকৃতি, নদীর গতিপথ আর বৃক্ষের বেদনা। জানানো হয়, শরীর থেকে শরীরে ঝাঁপ দেয়ার সূত্র ও সমীকরণ।

রঙ সম্পর্কে অন্ধদের ফিকে ধারণাগুলো পষ্ট-স্পষ্ট করা হয়; আর—অকেজো ও অদরকারী চোখগুলো তাদের অতি-অপ্রয়োজনীয় পাপড়ি, পলক ও অক্ষিকোটরসহ কালো কালো স্বপ্নদের ছিঁড়ে ফেলার আইনত অধিকার অর্জন করে।


দৃষ্টিসদন

(একটি অলাভজনক দৃশ্যদাতব্য প্রতিষ্ঠান)

পূর্ব আমোদাবাদ


মঞ্চদৃশ্য: লাল লাল আলোর নিচে একটি বাড়ি ও বাড়িসংলগ্ন বাগানচত্বর। এলোমেলো আসবাব, কাতশোয়া কলসি, উবুশোয়া হাঁড়ি, মাজাভাঙা কাঠের পুতুল ইত্যাদি।


পাত্র-পাত্রী: বিভিন্ন বয়সী সাতজন জন্মান্ধ, তিনজন নারী, চারজন পুরুষ, একজন দৃষ্টিবান নারী, চারু তার নাম।


সাতটি শেয়াল, কোরাস।


[মঞ্চের মাঝখানে খড়কুটো জ্বলছে। সাতজন জন্মান্ধ গোল হয়ে বসে আগুন পোহাচ্ছে]


সাতটি শেয়াল এলোমেলো ঘুরছে আর ছড়া কাটছে…


শেয়াল:

০১. কী দেখা যায়?   ফুল আর ফুল

০২. পাপড়ি নরম      গাল তুলতুল

০৩. বর্ণ কী তার?      নীল-কালো-লাল

০৪. হাসছে বুঝি!      ঘ্রাণেই মাতাল!


জন্মান্ধ-০১:

জন্ম থেকে অন্ধ—একরঙা পৃথিবীতে 

একটাই রঙ শুনি—কালো, ফিকে তার

জামা জুতো; গাঢ় নাকি চোখের মণি আর

অমাবশ্যায় চুল খুলে বেশ্যা মাগী হয়ে

অন্ধকার যোনি দিয়ে গিলে খায় মানুষের মুখ!

শুনতে পাই—পৃথিবীতে, জল আছে, ফল আছে

নদী আর নৈঃশব্দ্যে হেলান দেয়া গাছ!

আর যত ফুল!—তার যত রঙ, পাপড়ির

পোষাক খুলে ঘ্রাণের মদিরায়, বাতাসে বাতাসে

নাচ-নৃত্য! সুন্দরের সুন্দর, রূপকথার রূপসী!

কামিনী সে, বেহুলাও সে, জলজ্যান্ত প্রেম!


ওহহহ ঈশ্বর! আমারে দেখাও কেউ ফুল আর

ফুলের আগুন!!


চারু: [সাগ্রহে ফুল চেনাচ্ছে তাকে]

ফুল হলো বৃক্ষের যোনি! জন্মপথ, আশ্চর্য

দরোজা এক! পালকে পালকে বিস্ময়,

ঘ্রাণে মদ, দোদুল্যমান স্বর্গ…! প্রেম সে,

প্রেমিকাও। কাম সে কামিনীও! 


অজস্র প্রকারে ফোটে—বিন্দুতে, চন্দ্রবিন্দুতে;

গোলে-চৌকায়-চ্যাপ্টায়, খাড়া-তীর্যক-নতমুখে

কেউ কেউ ভাসমান, কেউ দুঃখের মতো দাউদাউ

কেউ শান্তির মতো ঠাণ্ডা, কেউ হতাশার মতো দীর্ঘজীবি! 


কেউ তো ঝরে গিয়ে মালা হয়ে বেঁচে থাকে অনন্তকাল!


শেয়াল: কোরাস

০১. কী দেখা যায়?   বৃক্ষমদন

০২. পুরুষ নাকি!      সুঠাম শরীর

০৩. শাখায় শাখায়    পাতার নাচন

০৪. ত্রিকাল জুড়ে      থির-স্থির!


জন্মান্ধ-০২:

শুনেছি তো—শুনতে পাই; কতিপয় আশ্চর্য

বৃক্ষঠাকুরের গল্প! একাধিকবার ছুঁয়ে দেখেছি,

নাগাল পাইনি। শুনেছি সটান পুরুষাঙ্গের মতো 

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, চিরকালীন অপেক্ষা নিয়ে বাঁচে!


ঈশ্বরী হে, আমি সেই বৃক্ষঠাকুরকে মুখস্ত করবো আজ!


চারু:

বৃক্ষরা মিথিক্যাল—দ্বৈতজননাঙ্গের গোপন রহস্য নিয়ে বাঁচে! 

বৃক্ষের স্বাস্থ্যে শুধু পুরুষালি শরীরের ঘ্রাণ; সুঠাম

বাহুতে দেবতার শক্তি ধরে, অথচ—বর্ষায়, 

জ্যোৎস্নায় ঋতুচক্র আসে, ফুলবতী হয়, নারী হয়ে

জন্ম দেয় ফুটফুটে ফলসন্তান!


জন্মান্ধরা সকলে: (সমস্বরে) আশ্চর্য! 


শেয়াল:

১. কী দেখবে আর?   নদীর দু’ধার

২. জলের নাচন         কী চমৎকার!

৩. জলে জ্যোৎস্না        নারীই নদী

৪. নদীতে চাই            জলসমাধি!


জন্মান্ধ-০৩:

জন্ম থেকে অন্ধ—যেদিকে হাত রাখি, হাতড়াই

যা কিছু স্পর্শে আসে, গন্ধে ও অনুভবে, সব সব

সবকিছু কালো! শোয়া, বসা, হাঁটা কিংবা সাঁতার

সবকিছু অন্ধকারে মোড়া! 

তিনশত একষট্টি বছরের সাসান্য ভ্রমণে

নদীর মুখ ও মস্তক, স্তন আর স্তন, নাভি কিংবা পা

আবিষ্কারে আসছে না!


ঈশ্বরী হে, আমারে জানাও তুমি নদীর প্রেরণা…


চারু:

বুকে থইথই জল নিয়ে খামখেয়ালি কিশোরী সে;

খলবলিয়ে চলে—গান গায় সুরে ও বেসুরে; 

হিংস্র সে, মাতঙ্গিনী—ক্রোধ এলে কামড়ে কামড়ে

মাটি খায় নিজেরই দু’কূল ভেঙে! 

প্রেম সে, আশ্চর্য নরম, মায়ের মতো মোলায়েম

বোনের মতো স্নেহ দেয়, স্ত্রীর মতো কাম

আহত প্রেমিকার মতো দুঃখ দেয় খুব!


মিথ্যে নয়, মিথ বলি তার—সত্যযুগে ভাতারের 

ঘর ছেড়ে নাঙ্গের খোঁজে রওনা করেছিলো মাগী, 

ত্রেতায় পায়নি, দ্বাপড়েও না, কলিযুগে সাতঘরে

ভিক্ষে করে খায়, প্রেমিকের দেখা পায়নি তবু 

হেঁটেই চলেছে… এমন ছেনাল!


সপ্তশেয়াল: (সমস্বরে)

প্রেম কি তবে জাদু নাকি! কেমন মায়া!

ঘরের লক্ষ্মী জাত বেহায়া…

নারী ছুটছে পুরুষ ছুটছে

হারিয়ে আবার কপাল কুটছে!


জন্মান্ধ-০৪:

জন্ম থেকে অন্ধ, চোখে নাই দৃশ্যের সুষমা!

নিজেরে দেখি নাই, লোকের মুখে শুনি—দুধে

আলতা গায়ের রঙ, চালতা ফুলের বোন!

কোমরে ঢেউ খেলে আর, অধরে আগুন ফোটে রোজ! 

দেখি নাই নিজের মুখ, গায়ের বর্ণ, হাসির ঝলক

অনুভবে এসেছি! চুল-চিবুক, গলা-বুক আর

জঙ্ঘায় ঝুলে থাকা ঠাণ্ডা-মৃত মাংসের ফুল! 


শুনেছি পুরুষের গাল-গল্প, দেখি নাই,

নাই কোন অনুভবে, স্বপ্নে অথবা কল্পনায়!


চারু: (ঈষৎ দুঃখিত)

[একজন উলঙ্গ পুরুষকে নারীটির সম্মুখে দাঁড় করিয়ে]

অন্ধফুল, তোমার জন্য অপার্থিব আয়োজন এই

নেই বলে যা কিছু—অনুভবে, কল্পনায়, তাই নাও হাতের মুঠোয়! 

তোমার জন্য এসেছে ঈশ্বরপুরুষ এক…


[নারীটি হাত বাড়ায়, স্পর্শ করে পুরুষটিকে। মুখ, চোখ, গলা, বুক, পেট-তলপেট সর্বত্র হাত বুলাতে থাকে সে, প্রথমে মৃদু তারপর একটু চঞ্চল!]


একটু উনিশ-বিশ, সবকিছু মিলে যায় হুবহু প্রায়

কিন্তু…বুকের মাপে মিলছে না খাপেখাপ!

লোমশ বেড়াল সে, অথচ আমার বুকে আছে

দুই মুঠো মাংসের পিণ্ড যে, তার নেই! কেন নেই!

তলপেটে মাংসের ফুল কই! নাতিদীর্ঘ, ঋজু অথচ

শক্ত-কোমল এই যা, ইনিই কি পুরুষাঙ্গ তবে!

আর এই থলথলে গোলমাংসের আদমফল

যেন এক্ষুণি ছিঁড়ে পড়বে ভাতের থালিতে…

কি বিশ্রী!


(নারীটি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়)


জন্মান্ধ-০৫:

কী সব এলোমেলো বাকবাকুম ঝরছে! এই যে,

পুরুষ ও তার পুরুষাঙ্গ, বহুবার নিজেকে ছুঁয়ে দেখেছি

যেন এক বিস্মিত সুন্দর!

শুনেছি তারও বেশি সুন্দর ফুলের নাম নারী।


এ নগরে কেউ কি নেই, যে আমাকে নারীর সুঘ্রাণ শেখাবে…


চারু: (নগ্ন এক নারীকে সম্মুখে দাঁড় করিয়ে)

এই তোমার হুর, স্বর্গ থেকে আসে; স্পর্শ করো


[জন্মান্ধটি স্পর্শ করে যথানিয়মে। মাথা মুখ স্তন নাভি যোনি ও জঙ্ঘায় হাত রেখে চমকে ওঠে যেন!]


বিপুল বিস্ময়! এখানে ওখানে থরে থরে

মাংসের ফুল! স্পর্শে আগুনের হল্কা ওঠে, 

পুড়ে যায় আঙুলের ডগা, থেমে যায় জিহ্বার স্বাদ!


চারু: ঘ্রাণ নিয়ে দেখো…

[পুরুষটি ঘ্রাণ নেয়, সমস্ত শরীরের]


পুষ্প নয়, পুষ্পের উদ্যান এ যে—মদ ও মদিরা

নেশা হয়, হৃৎপিণ্ডে বেজে ওঠে বাদ্য-বাজনা!


জিহ্বায় নুন, শুনেছি সাগরের জল এমন! 

অথচ মুঠোর ভেতরে যেন আস্ত, শান্ত অথচ

উষ্ণ এক শামুক ধরে আছি!


এখানেই কি জন্মের দরোজা তবে? শুনেছি যা

আমি আর আমাদের জন্মান্ধ পাপীরা তাহলে

এই পথেই পৃথিবীতে আসে!


[নগ্ন নারীটির সামনে একে একে সকল জন্মান্ধ হাঁটু গেড়ে বসে।]


হে আমার মাতৃদরোজা, তুমি কি অন্ধ-মূক-বধির?

দেবী ভেনাসের মুখ, তুমি কি প্রেম শেখো নাই!

কামার্ত কচ্ছপ তুমি? সঙ্গমসঙ্গীতে বাজো শুধু!


শরীরের তৃতীয় নয়ন তুমি, তবে কেন জন্ম দিলে

শুধু—চোখ দিলে, দৃষ্টি দিলে না!

|| সমাপ্ত ||

প্রিয় পাঠক,
ফেসবুক লগইনের মাধ্যমে এখানে আপনার মতামত জানাতে পারেন। এছাড়া খানিকটা নিচে জিমেইল লগইন করে, নাম বা ইউআরএল লিখে অথবা নামহীনভাবে মতামত জানাবার ব্যবস্থা রয়েছে।
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক, ‘ৎ’ (খণ্ড-ত)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ