আমিনুল ইসলাম সেলিমের ‘সংঘবদ্ধ অন্ধকার’ এবং আরও আটটি কবিতা

 

আমিনুল ইসলাম সেলিম


সংঘবদ্ধ অন্ধকার

কোথাও একটু রোদ সাদা বেড়ালের মতো
লাফিয়ে পড়ছে কি পড়ছে না
একটু হাস্যরত হাওয়া কলাবাদুরের মতো
দোল খাচ্ছে কি খাচ্ছে না
অমনি ‘ডাকাত পড়েছে, ডাকাত পড়েছে’ বলে
নেড়ি কুকুরের মতো পালাচ্ছে আবার
ফেলে যাচ্ছে মাঠজুড়ে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ
ফেলে যাচ্ছে হাতাশার অদম্য অসুখ
কারা যেনো সহস্র গুলির শব্দে ভেঙে দিচ্ছে মুক্ত কলরোল

অনেক সবুজ পাতা গাছে গাছে ওড়ায় নতুন দিন
নবজাত সুন্দরের আগাম খবর লিখে রাখে
ঘরে ঘরে শিশুদের হাসিমুখ ভরে ওঠে গাইদুধে
বুড়োদের- অঘ্রাণী ধানকোটা ভাতের ফেনায়
মাঠে মাঠে সম্ভাবনা-চারাগুলো গান গেয়ে নাচে
কিন্তু হঠাৎ
ভয়ঙ্কর ঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সব
রাক্ষসপাল এসে খেয়ে নেয় সমস্ত ফসল

কোথাও ফুটেছে ফুল, আলগোছে- ভীষণ রঙিন
কোথাও গানের পাখি গুনগুন নিজের ভেতর
নদীও সাঁতার কাটে বাতাসের আশকারা পেয়ে
মেঘের হাসির ঢেউ উড়ে যায় পাহাড়ে পাহাড়ে
অকস্মাৎ ধূর্ত হায়েনা এসে সব খেয়ে নেয়
হিংস্র আগুন এসে পোড়ে সব শুভ আয়োজন

এইভাবে সবখানে হিংস্রতা, ডাকাতি ও ছিনতাই
এইভাবে সবকিছু নষ্ট ও বেদখল, সবটা বিফল
আমাদের সমস্ত আলোর হাসি লুটে নেয় সংঘবদ্ধ অন্ধকার।


আঙুলে আঙুলে ভাব

তোমার চোখ নিয়ে কিছুই বলবো না
ওখানে কেবল বৃষ্টি আর মেঘের ছায়া দেখেছি
দৃষ্টির আলো দিয়ে আমি তাই কোনোদিন ছুঁতেই পারিনি

তোমার ঠোঁট নিয়ে বলবো না কিছু
ওখানে মরুতৃষ্ণার কাতরতা দেখেছি
কিন্তু কোনোদিন চুমুর জলে ভিজিয়ে দিইনি

তোমার চুল নিয়েও কিছু না
কেননা ওই চুলে ছিলো অন্তহীন অন্ধকার
এক সন্ধ্যায় আলগোছে বিলি কাটতে গিয়ে
প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো হাত

যে-টুকুন সম্পর্ক ছিলো
তা কেবল আঙুলেরই সাথে
একবার-
তোমার আঙুলজালে গেঁথেছিলো
আমার দু-হাতভরা সমস্ত আঙুল

ওরা ছিলো চুপচাপ
বাধ্যগত
সাম্যবাদী
বন্ধুত্বসুলভ

সেই থেকে আমার আঙুলগুলো
তোমার সে আঙুলে ব্যাকুল
সেই থেকে আমার আঙুলগুলো
ভালোবাসে তোমার আঙুল

তোমার আঙুলগুলো নিয়েছে কি
তোমার মতোই ছল-অভিনয়পাঠ?


আগুনের ইশতেহার

আগুন থেকে ছিটকে পড়লো দ্রোহ
আগুন থেকে ছিটকে পড়লো ক্রোধ
সম্মিলিত কান্নাগুলো
সর্বহারা দুঃখগুলো
মর্মভেদী কষ্টগুলো
একে-একে সমতল ছোঁয়

ঐক্যবদ্ধ ইশতেহার ঝরালো যে তপ্ত দানা
মর্ম তার এই:
অনির্বাণ দ্রোহ আর বাড়াবেন না
উর্ধ্বমুখো ক্রোধ আর বাড়াবেন না
কান্না, দুঃখ আর কষ্টকে সীমিত করুন
পৃথিবীতে মানব-হৃদয়ভার সব থেকে বেশি, তাই-
মানুষকে প্রাণ দিন, শান্তি দিন
মানুষকে স্বস্তি পেতে দিন

ইশতেহার ঘোষণার শেষে
সকলেই দলবেঁধে ঢুকে পড়ে আগুনের দেহে
আগুন জ্বলতে থাকে, দ্রোহে-ক্রোধে-দুঃখে অনিবার

মানুষ মূলত আগুনের উষ্ণ সমর্থক।


পলায়ন

নিজের গল্পের পাশ কাটিয়ে অন্যদের দিকে তাকাই
অন্যরা মুখ টিপে হাসে
অন্যরা ইশারাচর্চা করে
আমাকে গল্পচোর ভেবে তারা লুটিয়ে পড়ে হাস্যছলনায়

হতাশাক্লান্ত হয়ে প্রকৃতির মগ্নতাকে পড়ি
রপ্ত করি পাতাদের একান্নবর্তী আত্মবিশ্বাস
সেখানে আনন্দবৃক্ষ
সেখানে ফুলের সমাবেশ
ঘন হয়ে আসে চাপা হাওয়ার কোরাস
সেখানেও ঝুলে আছে মানুষের মূক ব্যথাগুলো

অন্যদের টেপামুখ আর ইশারাকে অন্ধকার-আয়নায়
ছুঁড়ে মারি, দেখি-
ছবি হয়ে ভেসে ওঠে বিষাদের কতো গল্প!
খাবিখাওয়া জীবনের বাঁকে বাঁকে কতো কতো ভুল!

গোপন আয়না ভেঙে ভুল ও বিষাদ থেকে সবাই পালায়...


শান্তি-সন্ধান

সড়ক খুঁজতে খুঁজতে আমরা বনের মধ্যে ঢুকে যাই।
ডারউইনের বানরেরা দলবেঁধে অভ্যর্থনা জানাতে এলে
আমরা তাদের অস্বীকার করি।
নদী খুঁজতে খুঁজতে আমরা কংক্রিটে হোঁচট খাই
সভ্যতা জিভ দেখাতে দেখাতে তেড়ে এলে
কোনোমতে পালিয়ে বাঁচি
আকাশ খুঁজতে খুঁজতে আমরা অন্ধকারে উড্ডীন হই
ভয়ঙ্কর পাখির ঠোঁট কলিজা বিদ্ধ করলে-
নিরুপায় বাতাসের পক্ষ নিই

এভাবে আমরা যেদিকে যাই- বিপদে পড়ি
এভাবে যেদিকে যাই- শত্রুর মুখে পড়ি
যেদিকে যাই- ব্যর্থ হই

অবশেষে আমরা মাটিতে নেমে আসি
কেবল মাটির কাছে শান্তি পাই
কেবল মাটির কাছে নির্ভরতা পাই
মাটি কি মায়ের বুক?
নাকি সে বাবার মতো সুশীতল ছায়া?


আলো ফুটবেই

যেদিকে তাকাই- লাশ
কর্তিত দেহ, কুচিকুচি কাটা হাত
যে দিকেই হাঁটি- ভয়
যেখানে দাঁড়াই রক্তস্রোতে ভাসি
কান পাতলেই পাশবিক গর্জন

কান্নার জলে বন্যায় ভাসে নদী
অসীম ব্যথায় ক্লান্ত দুঃখী মন
কথা না বলতে বলতে পাথর ভাষা
ভয় পেতে পেতে পেছানোর পথে দাঁড়ি

এবার দাঁড়াবো বুকে নিয়ে প্রত্যয়
এগোনোর পথে মানবো না কোনো বাধা
মিছিলে স্লোগানে কাঁপাবো অন্ধকার
আলো ফুটবেই, ঘুচবেই সব ব্যথা।


জীবনফাঁদ

দিনের উঠোন ব্যথায় তমসাঘন
রাত্রির বুক শীৎকারে ফালাফালা
পথপ্রান্তর ক্লান্ত শত্রুবানে
নদীসঙ্গমে নগর বাড়ায় মাথা

এইভাবে আলো পড়েছে ভুলের ফাঁদে
এভাবেই মানুষ অতি বেদনায় কাঁদে

স্নিগ্ধ কোমল গ্রামের যুবতীদেহে
বসত গেড়েছে উল্লম্ফন-হাওয়া
ক্ষেত ভরে গেছে আগাছার কারসাজে
সরলতা আজ বিষাক্রান্ত বায়ু

এইভাবে রোদ মরেছে অকালবেলা
এভাবে স্বপ্নে ঢুকেছে গ্রহণবেলা

শিশুরা ব্যস্ত যান্ত্রিক ম্যারাথনে
যৌবন গেছে উচ্ছন্নতা-বোধে
বার্ধক্যেও স্বজনরহিতি ব্যথা
পরিণতি এক ভয়াবহ শূন্যতা

এভাবে আকাশ ডুবেছে মেঘের বানে
এভাবে প্রাণের প্রাণ গেছে সবখানে।


নদীর জন্য হুঁশিয়ারি

কোনদিকে যাচ্ছো নদী? দাঁড়াও নির্বোধ!
ওদিকে সরকারি জমি, এদিকেও বেদখলি খাস
দেখছো ইটের স্তুপ তোমার মাথার ঠিক পাশে?
মালিকের মানা আছে, কিছুতেই ওদিকে যাবে না

তোমার পায়ের কাছে নাগরিক লালসার প্রশস্ত করাত
চোখের ময়লাজলে ভাসমান যুদ্ধবাজ সশস্ত্র জাহাজ
নদী তুমি স্থির হও, নিজের ভেতরে কাঁদো দুখিনী বেহুলা
তোমার মৃত্যু হবে আধুনিক সভ্যতার রক্তবমি খেয়ে।


স্বকৃত হিংসার প্রতি

ফ্রাঙ্কেস্টাইন,
আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন
বিশ্বাস করুন- এখন ঘুমেরই সময়
সমস্ত মানুষ আজ উচ্ছৃঙ্খল দৌড়োচ্ছে অন্ধকারে
কথা বলছে অবর্ণন কান্নার ভাষায়- হাসছে ছলনা করে, হায়!
আপনি দেখুন তো, মানুষের ভাষা আপনার পাঠযোগ্য? পড়তে পারেন?

আপনি ঘুমোন,
এতো নড়াচড়া করবেন না
একদম চোখ তুলে তাকাবেন না
মানুষের আত্মা নিয়ে খেলা বন্ধ হোক
ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে খেলা বন্ধ হোক
খেলা বন্ধ হোক মানুষের অনৈতিক শক্তিমত্তা নিয়েও

ফ্রাঙ্কেস্টাইন,
আপনাকে ঘুমোতেই হবে
আপনি জেগে থাকলে মানুষ অঘুমে থাকে
মানুষের বড় প্রয়োজন ঘুম আর শত্রুতা থেকে বিশ্রামের
আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন জাদুঘরে ডাইনোসরের কঙ্কালটির মতোন
মানুষের লাভাতপ্ত পৃথিবীকে ফিরিয়ে দিন শীতল ঝর্ণার মতো শান্তির কোলে।


প্রিয় পাঠক,
ফেসবুক লগইনের মাধ্যমে এখানে আপনার মতামত জানাতে পারেন। এছাড়া খানিকটা নিচে জিমেইল লগইন করে, নাম বা ইউআরএল লিখে অথবা নামহীনভাবে মতামত জানাবার ব্যবস্থা রয়েছে।
ধন্যবাদান্তে,
সম্পাদক, ‘ৎ’ (খণ্ড-ত)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ